পৃষ্ঠাসমূহ

এই ব্লগটি সন্ধান করুন

শুক্রবার, ৩১ আগস্ট, ২০১২

অপরাজিত - ২


পথের পাঁচালীতে অপু রেলগাড়ির শব্দ শুনেছিল বাড়ি থেকে, নতুন গ্রামে বাড়ির কাছেই রেললাইন, অপুর তাই দিদির কথা মনে পরে যায়। এবারে সে এই বাড়ি থেকে রেলগাড়ি দেখতে পাবে। এ ছবিতে রেলগাড়ি ব্যবহৃত হবে একটা প্রতীক হিসাবে, গ্রাম ও শহরের সংযোগের প্রতীক। অপু শহরে যাবে, মা পরে থাকবেন গ্রামের বাড়িতে। পৈতৃক পেশা হিসাবে যজমানি শুরু করলেও অপু তাই মায়ের কাছে আবদার করে স্কুলে ভরতি হবার। স্কুলে  নিজগুণে শিক্ষকদের স্নেহের পাত্র হয়ে ওঠার পরে শিক্ষকেরা তাকে পাঠ্যক্রমের বাইরে বই দেন, বলেন – বাংলাদেশের এক কোনে পড়ে থাকলেও মনটাকে বড় করে নেওয়া যায় বইয়ের মাধ্যমে। এই বইয়ের সূত্র ধরেই অপুর পৃথিবীটা বাংলাদেশের গ্রাম ছাড়িয়ে আরও বড় হয়ে উঠতে থাকে। পথের পাঁচালীর অপুর যাত্রার নায়ক সাজা আর অপরাজিততে আফ্রিকার আদিবাসী সাজার মধ্যে মৌলিক পার্থক্য এখানেই। অপু বিজ্ঞানের সহজ পরীক্ষা বাড়িতে হাতেকলমে করে দেখে, সূর্য ঘড়ি বানিয়ে তাতে সময় দেখে, মা কে গ্রহণের কারণ বোঝায়... শহর ছেড়ে গ্রামে ফিরে আসতে বাধ্য হলেও এইভাবে আধুনিকতার লক্ষে নিজের অগ্রগতি অব্যাহত রাখে আমাদের protagonist।
অপু জেলার মধ্যে ম্যাট্রিকে দ্বিতীয় হয়েছে। ১০ টাকা মাসিক জলপানি আর পুরস্কার স্বরূপ একটা ছোটো গ্লোব হাতে নিয়ে বাড়ি ফেরে অপু। গ্লোব হাতে নেবার মাধ্যমে সে যেন এক লহমায় বাংলার একটা ছোট্ট গ্রামের ছেলে থেকে বিশ্ব-নাগরিকে রূপান্তরিত হল। সর্বজয়ার সাথে প্রাথমিক দ্বন্দ্ব কাটিয়ে অবশেষে সে অনুমতি আদায় করে কলকাতা গিয়ে কলেজে পড়াশোনা করবার।
কলকাতা অপুর destination। এই গবেষণাপত্রের অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ বিষয় এই কলকাতা শহর। এই ট্রিলজির এতদূর পর্যন্ত অংশে কলকাতা প্রত্যক্ষ ভাবে না থাকলেও এটাই আধুনিকতার উদ্দেশ্যে অপুর গন্তব্য – একথা অনস্বীকার্য। আধুনিক শহুরে মধ্যবিত্ততার অন্যতম বড় উপাদান প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষা বা সহজ ভাষায় Degree। এই প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষার মাধ্যমেই এই গ্রামীণ শিক্ষিত মধ্যবিত্ত পরিবারের বালক একজন আধুনিক শিক্ষিত মধ্যবিত্ত নাগরিকে রূপান্তরিত হবে।
অপুর প্রথমবার কলকাতায় আসা সম্বন্ধে পরিচালক লিখছেন – “ ভিড়ে ভরতি ইস্টিশানের প্লাটফর্মে সে ট্রেন থেকে নামল – এটা দেখিয়েই সরাসরি কাট করে দেখাব, সে একটা বড় রাস্তা পার হচ্ছে। ঝিরঝির করে বৃষ্টি নামছে বলে সে একটা গাড়ি বারান্দার তলায় গিয়ে দাঁড়ায়। বৃষ্টি যতক্ষণ না একটু ধরছে, ততক্ষণ সে এখানেই থাকবে। সেই সময় সে দেখতে পাবে হরেক জাতীর মানুষকে। পশতু ভাষায় কথা বলছে দুজন কাবুলিওয়ালা, জনাকয়েক চীনে, তাদের হাতে খাঁচা, খাঁচার মধ্যে পাখি – এরা পাখিওয়ালা। এরাও কথা বলছে নিজেদের ভাষায়। অন্য জনা কয়েক পথচারী হিন্দিতে। ... এই যে একটা মস্ত শহরে সে প্রথম পা রাখছে, সেই উত্তেজনাটাকে তো ছবিতে ধরতে হবে।”
কলকাতা শহর, ট্রামরাস্তা, মটরগাড়ি, নানা জাতের নানা ভাষাভাষী মানুষ, আধুনিক metropolis জীবনের প্রতীক হয়ে দেখা দেয় অপুর কাছে। অপু খুঁজছে হ্যারিসন রোডের কাছে ৫৪ নম্বর পটুয়াটোলা লেনের রয়্যাল প্রেস। এরকম রাস্তার নাম ও নম্বরযুক্ত ঠিকানা একটা শহুরে আধুনিকতার চিহ্ন অপুর কাছে। আসলে এই ঠিকানা খোঁজার মাধ্যমে অপু নিজের জীবনের metropolis আধুনিকতাকেই সন্ধান করে চলেছে। এই প্রথমবার জীবনে তাকে একাএকা চ্যালেঞ্জের সম্মুখীন হতে হচ্ছে কারণ কলকাতায় পয়সা খরচ করে থাকবার সামর্থ্য তার নেই। এইভাবে অপুর প্রেসে চাকরী নেওয়া, ছোট্ট ঘরে থাকা, বৈদ্যুতিক আলো, এ সবই আধুনিক metropolis জীবনের স্বাদ বয়ে নিয়ে আসে তার কাছে, যে জীবনের কথা সে এতদিন বইতে পড়েছে, আজ থেকে সে সেই জীবন যাপন করবে। মনের আনন্দে সে মা কে চিঠি লিখতে বসে।
কলকাতায় সিটি কলেজে সাইন্স নিয়ে I.A. তে ভরতি হয় অপু, রোল নম্বর ৪৬। একটি প্রতিষ্ঠান, একটি ক্লাস, একটি group of people, রোল নম্বরের মাধ্যমে কোনও মানুষের পরিচয় নির্দেশ করা, এ সমস্তই অপুর কাছে আধুনিক মেট্রোপলিস জীবনের উপাদান। কলেজ, ক্লাস, রোল, প্রক্সি – এ সমস্ত নতুন শব্দগুলো দ্রুত অপুকে আরও আধুনিক করে তোলে। ক্লাস পালিয়ে কলকাতার গঙ্গার ঘাটে আড্ডা মারে অপু, এ ছবিতে দেখানো ভারতবর্ষের সর্বপ্রাচীন এবং নবীন দুটি শহরই গঙ্গার তিরে অবস্থিত, কিন্তু এদের চরিত্র আলাদা, কারণ কলকাতা দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ পরবর্তী অবস্থায় ক্রমে মেট্রোপলিসে রূপান্তরিত হয়েছে। পুলুর সাথে আড্ডা দেবার সময়েই বোঝা যায় এ সংসারে অপুর সবচেয়ে বড় এবং একমাত্র পিছুটান তার মা সর্বজয়া। বন্ধুর ঘড়িতে সময় দেখে অপু, পরিচালক কাট করে দেখান, বাড়িতে অপুরই বানানো সূর্য ঘড়ির পাসে তার মা তারই অপেক্ষায় বসে আছেন।
অপু ছুটিতে গ্রামের বাড়িতে ফেরে – কিন্তু মা ছেলের সম্পর্কের দূরত্ব আগের থেকে অনেক বেশি। তার কারণ, অপু সহজেই আধুনিকতাকে গ্রহণ করতে পারে, কিন্তু সর্বজয়া প্রাচীন pry modern feudal গ্রামীণ মধ্যবিত্ত মানসিকতার মানুষ। তাই মায়ের কলকাতা সম্বন্ধে জানাত আগ্রহ থাকলেও অপু কিছু বলার ইচ্ছে নেই। সর্বজয়া কলকাতায় গিয়ে থাকার কথা বলতে অপু ঘুমিয়ে পড়ে। মধ্যবিত্ত আর্থসামাজিক অবস্থাটা এক থাকলেও মা ও ছেলের মুল্যবোধে এখন অনেক তফাত, কারণ অপু এখন একজন শহুরে মধ্যবিত্ত। তাই গ্রামে মাদারির খেলা দেখে এখন অপু বিরক্ত হয়। গ্রামের জীবন সম্বন্ধে অপু এখন আগ্রহহীন; গ্রামের জীবনের আরাম, বিশ্রাম, সরলতা, ভালো খাবার, সহজ রোজগার, মাতৃস্নেহ... এ সব কিছু ছাড়িয়ে অপুর কাছে এখন অনেক বড় কলকাতার হাতছানি। Apu has gained the urge for Modernity. আমাদের protagonist নিশ্চিন্দিপুরের সেই ছোট্ট ছেলেটা এখন পুরোপুরি শহুরে মানুষ!
অপু পুজোর ছুটিতে বাড়ি যাবেনা – মানিঅর্ডারে দুটো টাকা পাঠাবার সাথে সে মাকে চিঠি লিখে এ খবর জানায়। আর সর্বজয়া সন্ধ্যার অন্ধকারে হঠাৎ মনের ভুলে অপুর ডাক শুনে দরজা খুলে পুকুরপাড়ে জোনাকির ঝিকিমিকি ছাড়া আর কিছুই দেখতে পায় না। মা অসুস্থ এই চিঠি পেয়ে গ্রামের বাড়িতে এসে অপু জানতে পারে সর্বজয়া মারা গেছেন। ভবতারণ তাকে গ্রামে থেকে যেতে বলেন। অপু জানায় তার পরীক্ষা আছে, কালীঘাটে সে তার মায়ের কাজ করবে। অপরাজিতের শেষ শট deep focus এ গ্রামের রাস্তা ধরে অপুর হেটে যাওয়া। জীবনে এই প্রথম বারের জন্য গ্রামের প্রতি তার আর কোনও পিছুটান রইল না, অপু এখন একজন সম্পূর্ণ শহুরে পিছুটান-মুক্ত আধুনিক মানুষ।

শুক্রবার, ২৪ আগস্ট, ২০১২

অপরাজিত - ১


এ ছবি শুরু হয় ১৩৩৭ সালে বারানসিতে। কাশিকে প্রথম দেখানো হয় গঙ্গার ওপর একটা রেল-ব্রিজে  চলন্ত ট্রেন থেকে। এই রেলগাড়ি যেন পথের পাঁচালীর সাথে অপরাজিতর মেলবন্ধন স্থাপন করল। কাশিকে Establish করা হয় গঙ্গা, গঙ্গার ঘাট, ঘাটে স্নানার্থী, কথকতা, পুজো-আচ্চা, শরীরচর্চা, পায়রার দল, ইত্যাদি নানা ঘটনা Deep focus এর মাধ্যমে তুলে ধরার মধ্যে দিয়ে। পৃথিবীর প্রাচীনতম জীবন্ত শহর এই বারানসিতেই আমাদের protagonist অপু প্রথম শহুরে মিশ্র সংস্কৃতির স্বাদ পায়। Deep focus এ দেখা যায় কাশির রাস্তায় দেওয়ালে আঁকা নানা ধরনের ছবি, কাশির অলিতে গলিতে বন্ধুদের সাথে ছোটাছুটি করতে দেখা যায় বালক অপুকে। অপু হিন্দি বলছে, জলকে বলছে পানি, মা কি খেয়েছে জিজ্ঞেস করায় উত্তর দিচ্ছে – ‘এক লাড্ডু... অউর এক পেঁড়া’। বদলে গেছে মা সর্বজয়ার সংসারও। ঘিঞ্জি পরিবেশে বারো ঘর এক উঠানের মিশ্র সংস্কৃতির মধ্যে আধুনিকতার প্রতীক হয়ে দাড়িয়ে থাকে জলের কল – সেখানে বাঁদরের সাথে লড়াই করে সেই কল থেকে জল সংগ্রহ করতে হয় সর্বজয়াকে। পাঠশালা যেতে না পারলেও শহরের আবহাওয়াতেই শিক্ষিত হয়ে উঠছে অপু, সে এখন জানে অপু ভালো ছেলে ইংরাজি Apu is a good boyতার অবাঙালী বন্ধু শম্ভু তাকে ইংরেজি শেখায়।  নগরায়নের প্রভাবে সর্বজয়ার রান্নাঘরেও এখন চা তৈরি হচ্ছে, অপু চা খাবে। এই সমস্ত দৃশ্যায়ন থেকে একটি গ্রামীণ মধ্যবিত্ত পরিবারের শহুরে মধ্যবিত্ত পরিবারে রূপান্তরিত হওয়ার প্রথম ধাপটিকে নির্দেশ করছেন পরিচালক। শহরে রোজগার বেশি, খরচও বেশি, সর্বজয়ার সখের ফরমায়েশ রাখতে হরিহর এখন কবিরাজি করছে, লোকের সঙ্গে হৃদ্যতা বাড়ছে, ফলে ধারে জিনিস আনার সুযোগ বাড়ছে। সর্বজয়ার তাতে কোনও আপত্তি নেই! এই সর্বজয়াই গ্রামে ছেলে নিয়ে না খেয়ে থাকার সময়েও মুখ ফুটে নিজের পড়শির কাছে টাকা ধার চাইতে পারেনি! শহুরে পরিবেশে এসে অনেক পুরনো মূল্যবোধই এখন আর আঁকড়ে ধরে থাকা যায় না।
দেওয়ালীর দিনে হরিহর প্রথম অসুস্থ বোধ করতে থাকলেও দেওয়ালীর কাশি অপুর কাছে প্রথম বারের জন্য শহুরে উৎসবের আমেজ তুলে ধরে। নাগরিকতায় নিজেকে দীক্ষিত করে তোলার পথে এই তার প্রথম ধাপ। সর্বজয়া প্রদীপ দিয়ে ঘর সাজায়, বাজি পোড়াতে পোড়াতে অপু এখন ঠুমরীর সুর গুনগুন করে। হরিহর অসুস্থ থাকাকালীন কামুক চরিত্রহীন প্রতিবেশীর নোংরামি থেকে নিজেকে কোনওরকমে রক্ষা করে সর্বজয়াশহরের এই নোংরামো সর্বজয়ার কাছে অপরিচিত, কারণ সে এবং হরিহর এই দুজনেই আসলে pry modern feudal গ্রামীণ সভ্যতার প্রতিভূ। এরা দুজনেই আধুনিকতার সামনে অপুর সবচেয়ে বড় পিছুটান – আধুনিক মানুষ হয়ে উঠতে গেলে অপুকে এই পিছুটান-হীনতাকে গ্রহণ করতে হবে, কারণ আধুনিক মানুষ পিছুটান-হীন
কাশিতে হরিহরের মৃত্যুকে অত্যন্ত dramatic করে দেখিয়েছেন পরিচালক, কারণ এই মৃত্যুটাই অপুর আধুনিকতার উদ্দেশ্যে যাত্রাপথে সবথেকে বড় turning point হরিহরের মৃত্যুর পরে সর্বজয়া একটি সম্পন্ন পরিবারে রাঁধুনির কাজ পায়। পরিবারের সকলেই তার কাজে সন্তুষ্ট ছিলেন বলে তাকে সেই পরিবারের সাথে তাদের বাড়িতে যেতে অনুরোধ করেন পরিবারের গৃহিণী। অপুও বেশ মানিয়ে নিচ্ছিল নতুন পরিবেশে, নিজের মত করে, বাড়ির কর্তা তাকে দিয়ে ফাই-ফরমাশ খাটান বটে, কিন্তু বকশিশও করেন, অপুকে তিনি বিশ্বাস করেন, তার পয়সার বটুয়া কোথায় থাকে, অপু জানে, নিজে হাতে তাকে সেটা এনে দেয়! বাড়ির কর্তা জানেন অপু ভদ্র ঘরের ব্রাহ্মণ-সন্তান, অভাবের তাড়নায় তার ও তার মায়ের আজ এই অবস্থা, অপু চুরি করবে না। ইতিমধ্যে সর্বজয়ার মেশোমসাই ভবতারণ তাকে অপুকে নিজের গ্রামের বাড়িতে নিয়ে রাখার আগ্রহ প্রকাশ করেন। এই দোলাচলের মধ্যে বিভ্রান্ত সর্বজয়া সিঁড়ি দিয়ে নামতে নামতে হঠাৎ দেখতে পায় অপু বাড়ির কর্তার হুঁকো নিয়ে যাচ্ছে তামাক সাজতে। সর্বজয়া সিধান্ত নেয় সে ভবতারণের সাথে গ্রামে ফিরে যাবে। একটি Zip Pan ব্যবহার করে পরিচালক আমাদের নিয়ে আসেন পরের দৃশ্যে, রেল গাড়ি করে সর্বজয়া আর অপু চলে আসছে ভবতারণের গ্রামে।
এই দৃশ্যের প্রসঙ্গক্রমে pry modern feudal গ্রামীণ মধ্যবিত্ত মানসিকতা ও মূল্যবোধ বিষয়ে একটি বিশেষ দৃষ্টিভঙ্গির পরিচয় পাওয়া যেতে পারে, যা থেকে বোঝা যায় ‘মধ্যবিত্ততা’ আপাতদৃষ্টিতে একটি আর্থ-সামাজিক অবস্থা বটে, কিন্তু তার থেকেও গভীর ভাবে দেখলে বিশেষ কিছু মূল্যবোধ দ্বারা পরিচালিত একটি জীবন দর্শন শহুরে জীবনে সর্বজয়ার পরিবারে ক্ষণস্থায়ী স্বাচ্ছন্দ্য এসেছিল, শহরের সুখ সুবিধায় অভ্যস্ত হয়ে পরছিল গ্রামীণ এই মধ্যবিত্ত পরিবারটি। নিশ্চিন্দিপুরে মিষ্টি কেনার জন্য অপু তার বাবার কাছে পয়সা চাইলে সর্বজয়া বাধ্য হয়ে বারণ করত, কিন্তু এখানে বাড়ির কর্তার দেওয়া পয়সা দিয়ে অপু বাঁদরদের জন্য খাবার কিনে তাদের খাওয়ায়, নিজের একাকীত্ব কাটায়। এই আর্থিক স্বাচ্ছন্দ্য অর্জন করতে গিয়ে এই পরিবারটিকে যা বিসর্জন দিতে হচ্ছিল, তা হল এই পরিবারের মধ্যবিত্ত মূল্যবোধের তকমা। নিরাপদ আশ্রয়, আর্থিক নিরাপত্তা, ভালো মন্দ খাওয়াদাওয়া, এই সমস্তই অপু ও সর্বজয়ার হতে পারত, এই সম্পন্ন পরিবারটির আশ্রয়ে থেকে, কিন্তু সর্বজয়ার কাছে দরিদ্র ব্রাহ্মণ পূজারী পরিবারের মূল্য বেশি বোধ হল, তার কারণ তার pry modern feudal গ্রামীণ মধ্যবিত্ত মানসিকতা ও মূল্যবোধ! সর্বজয়া গ্রামের শিক্ষিত পরিবারের বউ, অন্য পরিবারের আশ্রয়ে থাকলে তার সন্তানকে ভবিষ্যতে বড় জোর ও বাড়ির বাজার সরকার রূপে দেখা যেতে পারে, তার থেকে ভবতারণের গ্রামে গিয়ে অপুর পক্ষে পারিবারিক যজমান-বৃত্তিতে যোগ দেওয়া অনেক বেশি সম্মানজনক বলে মনে হয়েছে তার মায়ের কাছে। প্রসঙ্গত উল্লেখ্য, বিভূতিভূষণের মূল উপন্যাসে এই পর্বটির ব্যাপ্তি অনেকটাই বেশি, এই পর্বে লীলা নামে অপুর একটি বান্ধবীর উল্লেখ পাওয়া যায়। সত্যজিৎ প্রথমে এই অংশটিকে চিত্রায়িত করার পরিকল্পনা নিয়েছিলেন, পরে লীলার চরিত্রে উপযুক্ত অভিনেত্রী না পাওয়ার কারণে সেই পরিকল্পনা ত্যাগ করেন।
শ্রী ঋত্বিক কুমার ঘটক এই ছবিটির এই পর্যায় সম্বন্ধে মত প্রকাশ করেছেন – অপরাজিততে এই সুরটি (পথের পাঁচালীর theme) একবার মাত্র ব্যবহার হয়েছে, যেখানে সর্বজয়া অপুকে নিয়ে ট্রেনে করে বেনারস থেকে বাংলাদেশে ফিরে আসছেন। যেখানে জানলা দিয়ে যেই দেখা যায় ট্রেনটি বাংলাদেশে ঢুকছে – তখন মাত্র একবার এটি বেজে ওঠে। ... এই সুরটি সঠিক জায়গায় ব্যবহৃত হয়ে নিজেকে নিশ্চিন্দিপুর আর বাংলাদেশের সঙ্গে অঙ্গাঙ্গীভাবে জড়িয়ে নিয়েছে। অপরাজিত আমার মতে তার (সত্যজিৎ রায়ের) সর্বশ্রেষ্ঠ ছবি।

বুধবার, ১৫ আগস্ট, ২০১২

পথের পাঁচালী - ২



পথের পাঁচালী চলচ্চিত্রে যে দুটি চরিত্রের মৃত্যু ঘটে, তারা হলেন ইন্দির ঠাকুরন আর দুর্গা। একটি বাঁশঝাড়ের মধ্যে অপু দুর্গা ইন্দিরের মৃতদেহ আবিষ্কার করে, সেটাই মৃত্যু সম্বন্ধে তাদের প্রথম অভিজ্ঞতা। এরপর দুর্গার মৃত্যু হয় বৃষ্টির জলে ভিজে, নিউমোনিয়ায়। দুর্গার মৃত্যুর সম্বন্ধে লিখতে গিয়ে পরিচালক জানাচ্ছেন – অপুর পাঠশালায় যাবার দিন থেকে শুরু করে দুর্গার মৃত্যু পর্যন্ত এক বছর সময় কল্পনা করে চিত্রনাট্যের ঘটনাগুলিকে ঋতু অনুসারে ভাগ করে ফেলা হয়েছিল। চৈত্রের প্রথম বৃষ্টিতে ভিজে দুর্গার অসুখ। সেই থেকে হরিহরের ফিরে আসার দিন, ঘটনাগুলো সবই মেঘলা দিনে তোলা হয়েছিল। উপন্যাসের এই অংশের যে নিরবচ্ছিন্ন ভারাক্রান্ত mood, ছবির আলোতে তার প্রতিফলন মেঘলা দিনে shooting ছাড়া সম্ভব নয়।


ইন্দির ঠাকুরন এবং দুর্গার মধ্যে বয়সের ব্যবধান অনেকটা হলেও এরা দুজনেই কিন্তু আসলে একই pre-modern feudal গ্রামীণ সামন্ততান্ত্রিক সমাজব্যবস্থার প্রতিনিধি, তাই আধুনিকতার উদ্দেশ্যে যাত্রাপথে এদের থেমে যেতে হয়। পথের পাঁচালীতে কোথাও সরাসরি শহর বা আধুনিকতার reference নেই, কিন্তু অপুর রেলগাড়ি দেখবার ইচ্ছা, গভীর রাত্রে বহুদূর থেকে রেলগাড়ির আওয়াজ শোনা, এবং শেষ পর্যন্ত দুই ভাইবোনে কাশবনের মধ্যে লুকোচুরি খেলতে খেলতে হটাৎ রেলগাড়ি দেখা – এ সমস্তই আসলে আধুনিকতার সন্ধানকেই সূচীত করে। প্রসঙ্গত উল্লেখ্য, বিভূতিভূষণের মূল উপন্যাসে অপু দুর্গার রেলগাড়ি দেখার ঘটনাটা অনুপস্থিত, এবং এটি সত্যজিতের তোলা পথের পাঁচালীর প্রথম দৃশ্য। ছবির গল্প অনুসারে রেলগাড়ি দেখতে গিয়েই বৃষ্টিতে ভিজে দুর্গার অসুখ করে এবং তাতেই তার মৃত্যু হয়। দুর্গার মৃত্যুর পরেই পথের পাঁচালীর কাহিনীর উপসংহার আসে এবং দেখা যায় হরিহরের অবশিষ্ট পরিবার গ্রাম ছেড়ে কাশি যাত্রার মনস্থ করেছে। এই পর্যায়ে হরিহরের অনুপস্থিতিতে দুর্গার মৃত্যুর পরে সর্বজয়ার জীবনসংগ্রাম আসলে সর্বজয়ার প্রাক আধুনিক গ্রামীণ অবস্থাকেই সূচিত করছে। Trilogy র পরবর্তী পর্যায়ে দেখা যাবে, গ্রামীণ জীবনের সততার সংগ্রাম আধুনিক জীবনের যাত্রাপথে মূল্যহীন।


ছবির শেষ অংশে দেখা যায়, হরিহর ও সর্বজয়া অপুকে নিয়ে তাদের সাত পুরুষের ভিটে ছেড়ে নিজেদের বহুদিনের পরিচিত গ্রাম, গ্রাম্য জীবন ও মানুষজনকে ছেড়ে কাশি চলে যেতে বাধ্য হচ্ছে। এভাবে পরিচিতকে ছেড়ে অজানা অপরিচিতের দিকে কর্ম, বাসস্থান ও ভাগ্যের সন্ধানে পাড়ি দেবার মধ্যে যে Rootlessness, তাও আসলে আধুনিকতার উদ্দেশ্যে যাত্রাকে সূচিত করে, কারণ আধুনিক মানুষ শিকড়হীন, পিছুটান-হীন। যার সূত্র ধরে পরবর্তী পর্যায়ে আমাদের Protagonist অপু সমস্তকিছু ছাড়িয়ে আধুনিকতার উদ্দেশ্যে যাত্রা করবে। পথের পাঁচালীর শেষ দৃশ্যে বাড়ির জিনিসপত্র গুছাতে গিয়ে অপু খুঁজে পায় দুর্গার চুরি করা একছড়া পুতির মালা। সবাইকে লুকিয়ে অপু মালাটাকে পুকুরে ছুড়ে ফেলে দেয়, পুকুরের পানাগুলো বৃত্তাকারে মালাটিকে গ্রহণ করে, তারপর আস্তে আস্তে আবার ভরাট হয়ে যায়। পুতির মালা পুকুরে ডুবে যাবার সঙ্গে সঙ্গেই নিশ্চিন্দিপুরের ভিটের সঙ্গে সব সম্পর্ক শেষ হয় অপুদের। গরুর গাড়িতে করে তারা রওনা হয় অজানার উদ্দেশ্যে। অপুদের সঙ্গে তাদের মত গৃহহীন হয় তাদের বাড়ির বহু প্রাচীন বাস্তু-সাপ।      

সোমবার, ১৩ আগস্ট, ২০১২

পথের পাঁচালী - ১


নিশ্চিন্দিপুর নামে এক অখ্যাত অনামা এক দরিদ্র ব্রাহ্মন পরিবারের কাহিনিতে পথের পাঁচালীর সূচনা। পরিবারের কর্তা হরিহর যজমানি করে সংসার চালান। স্ত্রী সর্বজয়া, দূর সম্পর্কের দিদি ইন্দির ঠাকুরন এবং মেয়ে দুর্গাকে নিয়ে হরিহরের সংসার। সর্বজয়া গর্ভবতী, তার প্রতিবেশীরা কেউ তার প্রতি দুর্বিনীত, কেউ সংবেদনশীল। দরিদ্র জীবনের গ্রামীণ সঙ্কীর্ণতায় সর্বজয়া রূঢ়ভাষী, দূর সম্পর্কের ননদ ইন্দির ঠাকুরনকে সে তিরস্কার করে ঘর থেকে বের করে দেয়, অন্যের বাগানে ফল চুরি করার অপরাধে মেয়েকে মারধোর করে। ইন্দির, সর্বজয়া, দুর্গা, এরা সবাই আসলে প্রাক-বিশ্বযুদ্ধের আধা সামন্ততান্ত্রিক, আধা ঔপনিবেশিক গ্রামীণ সমাজব্যবস্থার প্রতিভূ, ফলে আধুনিকতা এদের আওতার বাইরে। এরপর অপুর জন্ম, ইন্দিরের আবার বাড়িতে ফিরে আসা। ইন্দিরের এই কয়েক মাস বাড়িতে অনুপস্থিতির সময়কালকে খুব সুন্দর ভাবে উপস্থাপন করেন পরিচালক, দেখা যায় দুর্গার প্রিয় বেড়াল বাচ্চাগুলো বড় হয়ে গেছে! অপুর বড় হয়ে ওঠার প্রথম দিন হিসেবে পরিচালক বেছে নেন অপুর পাঠশালা যাবার দিনটিকে। দুর্গা অপুকে ঘুম থেকে তুলে পাঠশালা পাঠানোর জন্য  ব্যাস্ত, ঘুমকাতুরে অপু দিদির তাড়নায় চাদরের ফুটো দিয়ে চোখ মেলে তাকায়, ভারতীয় সিনেমাও যেন এক নতুন দৃষ্টিতে নিজেকে খুজে পেল এই দৃশ্যের মধ্য দিয়ে! এই পাঠশালা যাবার দিনটিকে চিহ্নিত করার মাধ্যমে আধুনিকতার দিকে যাত্রাপথের প্রাথমিকতম বৈশিষ্টটিকে নির্দেশ করলেন পরিচালক। আধুনিক মানুষ হয়ে উঠতে অপুর সবচেয়ে বেশি প্রয়োজন অক্ষরজ্ঞান (Literacy)। শিক্ষার প্রতি এই দরিদ্র পরিবারটির আগ্রহ তাদেরকে গ্রামের অন্যান্য পরিবারের থেকে আলাদা করে তুলতে সাহায্য করে। এই ছবিতে প্রকাশ পায়, হরিহরের পূর্বপুরুষেরা বংশানুক্রমিক ভাবে শিক্ষিত ছিলেন। হরিহর নিজেও যাত্রাপালা লিখে রোজগার বাড়ানোর ইচ্ছা রাখে।

এইভাবে গ্রামের আর পাঁচটা সাধারণ ছেলের মত অপু বড় হয়ে উঠতে লাগল। দিদি দুর্গার সঙ্গে মিষ্টিওলার পিছু পিছু দিদির বন্ধুর বাড়িতে যাওয়া, লুকিয়ে আঁচার খাওয়া, চড়ুইভাতি, ইত্যাদি সমস্ত কিছুতে দিদির সঙ্গী হলেও আসলে কিন্তু তারা দুজন দুটো আলাদা সময়কে উপস্থাপন করে। দুর্গা গ্রামের মেয়ে, গ্রামের মেয়ের মতই সরল, তার গ্রামই তার পৃথিবী, তার জগত-সংসার। চড়ুইভাতি করতে করতে সে তার প্রিয় বান্ধবীর বিয়ের আর কতদিন বাকি, তার হিসেব করে, এটাই তার কাছে সবচেয়ে আনন্দের কাজ। অন্যদিকে, অপু কল্পনাপ্রবণ। ইন্দির ঠাকুরনের কাছে শোনা রূপকথা অথবা যাত্রায় দেখা পৌরাণিক কাহিনী সে নিজের মনের মত করে একা একা অভিনয় করে বেড়ায়। নতুনকে জানার এবং নিজের মত করে বোঝার এই আগ্রহটাই আধুনিকতার প্রতি অপুর সবথেকে বড় চালিকাশক্তি। এই আধুনিকতার অভিমুখে যাত্রাপথে তাকে প্রতক্ষ করতে হবে পাঁচজন প্রিয় মানুষের মৃত্যু, কারন তার পরিবারের অন্য পাঁচজনের এই আধুনিকতার পথে চলার ক্ষমতা ছিলনা। এই Trilogy তে প্রত্যেকটি মৃত্যু কোনও একটি বিশেষ সময়ের সমাপ্তি ঘোষণা করে, এবং কোনও একটি নতুন সময়ের জন্ম দেয়।

শনিবার, ১১ আগস্ট, ২০১২

অপু ট্রিলজি - ২



Calcutta Film Society এর পত্তনের (1947) ঠিক পরে পরেই সিনেমা বিষয়ক তার প্রথম প্রকাশিত প্রবন্ধ ‘What is wrong with Indian Cinema’ তে সত্যজিৎ মত প্রকাশ করছেন, ভারতীয় সিনেমার সবচাইতে বেশি প্রয়োজন একটা নিজস্ব শৈলী, একটা বিশেষ প্রকাশভঙ্গী, একটা আপন রূপ, যাতে সিনেমাটি দেখা মাত্র দর্শক নিঃসংশয় হতে পারে যে তারা একটি ভারতীয় সিনেমাই দেখছে। এই সোসাইটি পত্তনের মাধ্যমেই একাধিক সমমনস্ক মানুষের সাথে পরিচিত হন সত্যজিৎ, যাদের মধ্যে উল্লেখ্য – বংশী চন্দ্রগুপ্ত, চিদানন্দ দাসগুপ্ত, মনোজ মজুমদার প্রমুখ। সমসাময়িক প্রেক্ষাপটে দাড়িয়ে নিজের শিল্প-ভাবনাকে এই নতুন মাধ্যমে প্রকাশ করার তাগিদ তখন থেকেই অনুভব করতে থাকেন সত্যজিৎ।

1949 সালে ফরাসী চিত্রপরিচালক জা রেনোয়া কলকাতায় আসেন গঙ্গা নিয়ে তার ছবি ‘The River’ এর কাজে। রেনোয়ার ভক্ত সত্যজিৎ সে সময়ে তার সাথে গিয়ে দেখা করেন এবং ‘পথের পাঁচালী’ ছবির সম্ভাব্য আখ্যান অংশটি তাকে শোনান। রেনোয়া সত্যজিতকে উৎসাহিত করেন এবং হলিউডের চলচ্চিত্রের নকলনবিশী করার থেকে বিরত থাকতে বলেন।

দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের শেষভাগে সূচিত হওয়া Italian Neo-realism সত্যজিতকে বিশেষভাবে প্রভাবিত করেছিল। 1950 এর April মাসে বিজ্ঞাপন সংস্থার কাজে সস্ত্রীক ইউরোপে যাবার সময় জাহাজে পথের পাঁচালী সম্বন্ধে নোট করতেন সত্যজিৎ। ইউরোপে গিয়ে De Sica র The Bicycle Thief দেখার অভিজ্ঞতা সম্বন্ধে সত্যজিৎ বলেছেন, একদম সঠিক সময়েই তিনি এই ছবি দেখেছিলেন, কারণ তিনি তার ছবিতে যা দেখাতে চাইছিলেন, ডি সিকা ঠিক সেটাই তার ছবিতে করে দেখিয়েছেন, এবং তাতে অপরিমেয় ভাবে সফলও হয়েছেন। ডি সিকা তার সমস্ত সহানুভূতি ঢেলে দারিদ্রের যে ছবি আঁকতে চেয়েছিলেন, অনভিজ্ঞ নতুন লোক দিয়ে বিনা মেকআপে অভিনয় করানো, বৃষ্টির মধ্যে শুটিং করা, এমনকি পুরনো raw stock ব্যবহার করার জন্য ছবিতে যে গ্রেনগুলো তৈরি হয়েছিল, এ সবই যেন সেই দারিদ্রের আখ্যানকেই আরও স্পষ্ট করে তুলেছে।

ডি সিকার ছবিতে যে জিনিসটা সত্যজিতকে সবচেয়ে বেশি প্রভাবিত করেছিল, তা হল Long Take ও Deep focus এর মাধ্যমে স্থান ও কালকে সূচিত করবার নতুন পন্থা। Apu Trilogy র চিত্রায়নে এই লং টেক, ডিপ ফোকাসের বহুল ব্যবহার, চিত্রভাষায় বিভিন্ন ডিটেলের মাধ্যমে আর্থসামাজিক প্রেক্ষাপটকে প্রকাশ করা, মেকআপ ছাড়া অভিনয় করানো, অপেশাদার অভিনেতা অভিনেত্রীদের দিয়ে অভিনয় করানো, স্বাভাবিক সূর্যের আলোয় ছবি তোলা, এবং প্রায় পুরো shooting টাই outdoor এ করা (বোড়ালগ্রাম এ), এ সমস্তই Neorealist ছবির বৈশিষ্ট্য বহন করে। সকালে যে আলো কাজের উপযোগী, সেটা পাওয়া মাত্র শুটিং শুরু হত, দুপুর একটা নাগাদ গরমের জন্য ঘণ্টা-খানেক কাজ থামিয়ে দুপুরের খাওয়া খেয়ে নেওয়া হত, তারপর যতক্ষণ আলো পাওয়া যায় ততক্ষণ অবধি শুটিং চলত। অধিকাংশ অভিনয়শিল্পী ছিলেন নবাগত। বৃদ্ধা ইন্দির ঠাকুরনের চরিত্রে অভিনয় করেছিলেন অতীত রঙ্গমঞ্চের অভিনেত্রী চুনিবালা দেবী। গ্রামের বৃদ্ধদের ভূমিকায় অভিনয় করেন বোড়াল গ্রামের গ্রামবাসীরা, যাদের প্রায় কারুরই কোনোরকম অভিনয়ের কোনও অভিজ্ঞতা ছিল না। চিত্রনাট্যের সংলাপ হিসাবে অধিকাংশ ক্ষেত্রে ব্যবহার করা হয়েছিল বিভূতিভূষণের  লেখা উপন্যাসের চরিত্রের সংলাপ। কোনও চরিত্রের জন্যই কোনোরকম মেকআপ ব্যবহার করা হয়নি। অভিনেতাদের মধ্যে কানু বন্দ্যোপাধ্যায় ছিলেন পেশাদার। শুটিঙের সময় বিনা মেকআপে অভিনয় করা নিয়ে তার খুঁতখুঁতেমির অন্ত ছিল না, তার মতে ওটা ছিল ঘোর উদ্ভট একটা কাণ্ড। বিভূতিভূষণের লেখা সংলাপ বলতে যে বড্ড সময় লাগে, এটা নিয়েও তার আপত্তি ছিল।
        
এই সমস্ত বৈশিষ্ট গুলোকে বিচার করে বলা যেতে পারে, Apu Trilogy হল ভারতবর্ষের তথা এশিয়ার প্রথম মুক্তিপ্রাপ্ত সার্থক প্রপঞ্চবাদী বাস্তবমূলক (Phenomenological Realism) চলচ্চিত্র, যেখানে একটি কাল্পনিক ঘটনাকে (বিভূতিভূষণের উপন্যাস) বাস্তবানুগ করে দেখানোর জন্য চলচ্চিত্রশিল্পের সমস্ত কলাকৌশল ও মালমসলাকে প্রয়োগ করা হয়েছে। Neorealist ছবির আর একটি অন্যতম উল্লেখযোগ্য বৈশিষ্ট শহরকেন্দ্রিকতা এই Trilogy-র প্রথম ছবিটিতে অনুপস্থিত হলেও এটাই এই Trilogy-র প্রধান গন্তব্য তথা উদ্দেশ্য, যা আধুনিকতার প্রধান সূচক।

বৃহস্পতিবার, ৯ আগস্ট, ২০১২

ভরসা থাকুক...


সামান্যতম পরিচয়, তার সঙ্গীত-পরিচালনায় একটা সিনেমার recording এ গান গেয়েছিলাম আরও বেশ কয়েকজন বন্ধুর সাথে। Play back এর কোনোরকম অভিজ্ঞতা না থাকায় বেশ ভয়ে ভয়েই গেছিলাম studio তে। কিন্তু সেখানে পৌঁছতেই ভয়টা একদম ভ্যানিশ হয়ে গেল... অসম্ভব রকম friendly atmosphere, শীতের সকালে বেশ একটা পিকনিক পিকনিক পরিবেশে কাজে একদম চাপ নেই, কিন্তু গতি আছে যথেষ্টই। ফলে নির্ধারিত সময়ের অনেক আগেই গান recording শেষ, তারপর সবাই মিলে জমিয়ে আড্ডা, খাওয়াদাওয়া!

বছর ঘুরে এখন বর্ষা, facebook এ একটা friend request পাঠিয়েছিলাম, আমি খুব অকারণ বাজে বকি (recording এর দিনও তার অন্যথা হয়নি!), তাই হয়তো আমায় মনে থাকলেও থাকতে পারে, এই ভরসায়! Request accepted, বুঝলাম আমার অনুমান নির্ভুল! Dissertation এ একটা সাংঘাতিক গালভরা topic বেছে আমি এখন বাস্তবিকই নাকের জলে, চোখের জলে... ছেড়ে দে মা, কেঁদে বাঁচি অবস্থা! সেজন্য একজন Music Director এর Interview দরকার ছিল, আশায় বুক বেঁধে অনুরোধ করলাম একদিন একটু সময় দেওয়ার জন্য। ব্যস্ততার ওজুহাতে না বলে দেওয়াটাই সম্ভবত বর্তমানে Industry-র প্রচলিত রীতি, কিন্তু তিনি সে পথের পথিক নন একেবারেই। প্রায় সাথে সাথেই সময় ঠিক করে দিলেন। তিনি প্রবুদ্ধ বন্দ্যোপাধ্যায়, আমাদের প্রবুদ্ধদা।

নির্ধারিত দিনে Interview, তারপর চা বিস্কুট সহযোগে আড্ডা। নিজে থেকেই জিজ্ঞাসা করলেন, এরকম একটা টপিক নিয়ে কাজ করছি কেন, কাজ কতটা এগিয়েছে, আরও কার কার Interview দরকার! তারপর নিজের পরিচিত মহল থেকে বেশ কিছু অত্যন্ত দরকারি Interview ব্যবস্থা করে দিলেন সাথে সাথেই। আমি মনে মনে ভাবছিলাম, এই Interview গুলো যোগার করার জন্য কতজনকে অনুরোধ জানিয়েছি কতবার! কেউ আজ দেখছি, কাল দেখছি বলে পাশ কাটিয়েছে, কেউবা বন্ধুর মুখোশ পরে নিজের স্বার্থের ঝুলি খুলে বসেছে! বাড়িতে গঞ্জনা শুনতে হয়েছে, এই লাইনটাই নাকি এরকম, আমি নাকি জেদ করে সিনেমা নিয়ে পড়ে থেকে নিজের ভবিষ্যৎ জলাঞ্জলি দিচ্ছি! এ কদিনে নানা অভিজ্ঞতায় নিজের মনের কোণেও এই ভাবনাগুলো উঁকি দিচ্ছিল মাঝে মাঝেই, প্রবুদ্ধদা এক লহমায় সেগুলোকে অনেক দূরে সরিয়ে দিয়ে মনটাকে হালকা করে দিলেন।


ঘরে বাইরে কতটা লড়াই করে এই কাজে নিজেকে টিকিয়ে রেখেছি, সেটা খুব কাছের কয়েকজন মানুষ ছাড়া কেউ জানে না। প্রবুদ্ধদার সাথে চা খেতে খেতে কথা হচ্ছিল, Rotterdam Film Festival এর অভিজ্ঞতা প্রসঙ্গে বলছিলেন Corporate World কি ভয়ঙ্কর ভাবে প্রত্যেকটি শিল্পকে নিয়ন্ত্রণ করতে বদ্ধপরিকর, সিনেমাও তার ব্যতিক্রম নয়। আর সাথে সাথেই উঠে আসছিল অন্য আর এক সংগ্রামের কাহিনী, সেই সব মানুষগুলোর কথা যারা দিনের বেলায় McDonald’s এ কাজ করে রাত্রে সিনেমা ভাবে! বলে – Producer এর দরকার নেই, নিজেরা আধপেটা খেয়ে পয়সা বাঁচিয়ে সিনেমা বানিয়েছি! সেই অনেক দুরের মানুষগুলোর সাথে সেই মুহূর্তে কেমন একটা নিবিড় আত্মীয়তা খুঁজে পেলাম। খুঁজে পেলাম নিজের ভালবাসার বিষয়কে আঁকড়ে ধরে কাজ করে যাবার মনের জোর। আপনাকে ধন্যবাদ, প্রবুদ্ধদা। আপনার মত মানুষেরা যতদিন আছেন, ততদিন আমার মত নতুন মুখেরা নির্ভয়ে Industry তে কাজ করতে আসবে, সিনেমাকে ভালোবেসে। আমার প্রণাম নেবেন।

সোমবার, ৬ আগস্ট, ২০১২

জাদুকরি

জাদুকরি

কথা ছিল, University তে একটা workshop হবে, যেখানে আমরা সবাই, অর্থাৎ টিচার, স্টুডেন্ট সবাই মিলে একসাথে একটা short film বানাবো। সবার খুব উৎসাহ, প্রত্যেক ছাত্র-ছাত্রীকে বলা হল নিজের মতো করে গল্পের একটা প্লট ভেবে আসার জন্য। এমন একটা concept, যেটা university – র campus এর ভেতরেই shoot করা যাবে, বাইরে যেতে হবেনা! আমিও ভাবলাম, মানে বলা ভালো, ভাবা practice করলাম, হাজার হোক সিনেমার ছাত্রী তো! Practice এর সাথে theory কে না মেলালে চলবে কি করে! অনেক ভাবনা চিন্তার পর যা দাঁড়ালো সেটা খানিকটা গুল-গাপ্পি, খানিকটা জোড়া-তাপ্পি, খানিকটা স্বপ্ন, খানিকটা বাস্তব, খানিকটা আগের দিন অনেক রাত অবধি জেগে Pino Solanas এর “La Nube” দেখার ফল, এবং সিকি ছটাক মতো হলেও আত্মজীবনী! আমার concept এ এক ঝলকের জন্যও আমি দেখা দিয়ে যাব না, সে কি কখনো হতে পারে! পরের দিন University গিয়ে দেখি কয়েকটা concept থেকে একটু একটু করে অংশ নিয়ে একটা কোলাজ মত করা হচ্ছে, একটু প্রেম, একটু homosexuality, একটু প্রতিবাদ, একটু ব্যাঙ্গ ইত্যাদি দেখিয়ে শেষে দেখানো হবে এটা আসলে একটা workshop হচ্ছিল, যেখানে ছাত্র-ছাত্রীরা সবাই কাজ শিখছে। আমার concept টা অনেকেরই পছন্দ হয়েছিল, কিন্তু ওটা থেকে একটু কিছু বার করে নেওয়া সম্ভব হল না! অনেক কিছু establish করতে হবে যে! ফলে ভাবা practice বৃথা গেল! কিন্তু জীবনের ধন কিছুই কি যাবে ফেলা? অনেকেরই যখন ভালো লেগেছে, তখন ওটা ‘সিনেকথা’-র বন্ধুদের সাথে শেয়ার করা যাক না কেন!

জাদুকরি

শুক্রবার, ৩ আগস্ট, ২০১২

অপু ট্রিলজি


বাংলা সাহিত্যে রবীন্দ্র পরবর্তী আধুনিক উপন্যাসের ধারাকে পুষ্ট করেন তিন বন্দ্যোপাধ্যায়, মানিক, তারাশঙ্কর ও বিভূতিভূষণ। বদলে যাওয়া বাঙালি মানসিকতার ছবি পাওয়া যায় এই তিন লেখকের উপন্যাস, ছোটগল্পে। বিভূতিভূষণের ‘পথের পাঁচালী’ অবলম্বনে সত্যজিৎ রায়ের অমর সৃষ্টি Apu Trilogy। প্রথম জীবনে বিজ্ঞাপন সংস্থায় কর্মরত থাকাকালীন এই উপন্যাসের কিশোর-পাঠ্য সংস্করণের Illustration তৈরির সময় থেকেই সত্যজিতের মনে হয়, এ থেকে একটা ভালো সিনেমা তৈরি করা সম্ভব। সিগনেট প্রেস থেকে ১৯৪৫ সালে প্রকাশিত পথের পাঁচালীর কিশোর-পাঠ্য সংস্করণ ‘আম-আঁটির ভেঁপু’ – র সম্পাদনার দায়িত্বে ছিলেন সজনিকান্ত দাস, অলঙ্করণের দায়িত্ব ছিল সত্যজিতের ওপর। ছবি আঁকার আগে পুরো উপন্যাসটি খুব মন দিয়ে পড়তে হয়েছিল সত্যজিতকে, তখন থেকেই বিভূতিভূষণের চরিত্র চিত্রণের দক্ষতা তাকে বিশেষ প্রভাবিত করে। পরবর্তীকালে বিভূতিভূষণের উপন্যাসের সংলাপ প্রসঙ্গে সত্যজিৎ লিখেছেন যে এই সংলাপ যেন সরাসরি লোকের মুখ থেকে কথা তুলে এনে কাগজে বসিয়ে দেওয়া, সংলাপগুলি এতটাই চরিত্রপোযোগী, যে লেখক নিজে চরিত্রের আকৃতিগত কোনও বর্ণনা না দিলেও চেহারাটা যেন আমাদের সামনে ফুটে ওঠে কেবল সংলাপের গুনে। ধারনা করা যায়, বিভূতিভূষণের উপন্যাসের এই বৈশিষ্ট্যই সত্যজিতকে উৎসাহিত করেছিল নতুন ধারার চিত্রনাট্য ও চলচ্চিত্র নির্মাণে।

১৮৪০ সালে শিল্প বিপ্লবের পরবর্তী সময় থেকেই পৃথিবীর ইতিহাস ও ভূগোল দুটোরই দ্রুত পরিবর্তন হতে থাকে। এই সময় থেকেই উৎপাদন বৃদ্ধির ফলে মানুষ পৃথিবীর বিভিন্ন দেশে ছড়িয়ে পড়তে থাকে, গড়ে উঠতে থাকে colony, এবং colonialism। এই সময় থেকেই আধুনিকতার বিকাশ হয়, যার ফলশ্রুতি Modernity, Modernization, Modernism ইত্যাদি। এই সব কিছুর মাধ্যমেই শহরগুলোর নিজস্ব চরিত্র বিকশিত হয়ে ক্রমে ক্রমে গড়ে উঠতে থাকল একটা Multi Cultural / Cross Cultural environment। এর প্রায় এক শতাব্দী পরে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পরবর্তী সময় থেকেই প্রথম বিশ্বের দেশগুলি তাদের কলোনিগুলোকে স্বাধীনতা দেওয়ার প্রক্রিয়া শুরু করতে বাধ্য হয়। এর ফলে উন্নয়নশীল দেশগুলিতে গ্রামের মানুষের শহরমুখী হবার প্রবণতা ব্যাপকভাবে বৃদ্ধি পেতে থাকে, শহরগুলির চরিত্র নানা জাতির সংমিশ্রণে দ্রুত পরিবর্তিত হয়ে আধুনিক Metropolis সভ্যতার সূচনা করে। এই সময়কালই পথের পাঁচালীর পটভূমি। সত্যজিৎ রায়ের Apu Trilogy আসলে এইরকম একজন সাধারণ গ্রামীণ মানুষের আধুনিকতার অভিমুখে যাত্রার কাহিনী – It’s a story that indicates a journey towards Modernity! সাধারণ দৃষ্টিভঙ্গিতে এটিকে একটি শিশুর বড় হয়ে ওঠার কাহিনী বলে মনে হলেও, আসলে এটি আমাদের Protagonist অপুর একজন আধুনিক মানুষ হয়ে ওঠার কাহিনী। বাংলার একটি অখ্যাত আনামা গ্রাম নিশ্চিন্দিপুরের এক অতি সাধারণ পরিবারের ছেলে অপু কিভাবে নিজেকে বিশ্ব-নাগরিকতার পরিচয়ে আবিষ্কার করে, তাই এই ট্রিলজির মূল উপজীব্য...