পৃষ্ঠাসমূহ

এই ব্লগটি সন্ধান করুন

শনিবার, ১১ আগস্ট, ২০১২

অপু ট্রিলজি - ২



Calcutta Film Society এর পত্তনের (1947) ঠিক পরে পরেই সিনেমা বিষয়ক তার প্রথম প্রকাশিত প্রবন্ধ ‘What is wrong with Indian Cinema’ তে সত্যজিৎ মত প্রকাশ করছেন, ভারতীয় সিনেমার সবচাইতে বেশি প্রয়োজন একটা নিজস্ব শৈলী, একটা বিশেষ প্রকাশভঙ্গী, একটা আপন রূপ, যাতে সিনেমাটি দেখা মাত্র দর্শক নিঃসংশয় হতে পারে যে তারা একটি ভারতীয় সিনেমাই দেখছে। এই সোসাইটি পত্তনের মাধ্যমেই একাধিক সমমনস্ক মানুষের সাথে পরিচিত হন সত্যজিৎ, যাদের মধ্যে উল্লেখ্য – বংশী চন্দ্রগুপ্ত, চিদানন্দ দাসগুপ্ত, মনোজ মজুমদার প্রমুখ। সমসাময়িক প্রেক্ষাপটে দাড়িয়ে নিজের শিল্প-ভাবনাকে এই নতুন মাধ্যমে প্রকাশ করার তাগিদ তখন থেকেই অনুভব করতে থাকেন সত্যজিৎ।

1949 সালে ফরাসী চিত্রপরিচালক জা রেনোয়া কলকাতায় আসেন গঙ্গা নিয়ে তার ছবি ‘The River’ এর কাজে। রেনোয়ার ভক্ত সত্যজিৎ সে সময়ে তার সাথে গিয়ে দেখা করেন এবং ‘পথের পাঁচালী’ ছবির সম্ভাব্য আখ্যান অংশটি তাকে শোনান। রেনোয়া সত্যজিতকে উৎসাহিত করেন এবং হলিউডের চলচ্চিত্রের নকলনবিশী করার থেকে বিরত থাকতে বলেন।

দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের শেষভাগে সূচিত হওয়া Italian Neo-realism সত্যজিতকে বিশেষভাবে প্রভাবিত করেছিল। 1950 এর April মাসে বিজ্ঞাপন সংস্থার কাজে সস্ত্রীক ইউরোপে যাবার সময় জাহাজে পথের পাঁচালী সম্বন্ধে নোট করতেন সত্যজিৎ। ইউরোপে গিয়ে De Sica র The Bicycle Thief দেখার অভিজ্ঞতা সম্বন্ধে সত্যজিৎ বলেছেন, একদম সঠিক সময়েই তিনি এই ছবি দেখেছিলেন, কারণ তিনি তার ছবিতে যা দেখাতে চাইছিলেন, ডি সিকা ঠিক সেটাই তার ছবিতে করে দেখিয়েছেন, এবং তাতে অপরিমেয় ভাবে সফলও হয়েছেন। ডি সিকা তার সমস্ত সহানুভূতি ঢেলে দারিদ্রের যে ছবি আঁকতে চেয়েছিলেন, অনভিজ্ঞ নতুন লোক দিয়ে বিনা মেকআপে অভিনয় করানো, বৃষ্টির মধ্যে শুটিং করা, এমনকি পুরনো raw stock ব্যবহার করার জন্য ছবিতে যে গ্রেনগুলো তৈরি হয়েছিল, এ সবই যেন সেই দারিদ্রের আখ্যানকেই আরও স্পষ্ট করে তুলেছে।

ডি সিকার ছবিতে যে জিনিসটা সত্যজিতকে সবচেয়ে বেশি প্রভাবিত করেছিল, তা হল Long Take ও Deep focus এর মাধ্যমে স্থান ও কালকে সূচিত করবার নতুন পন্থা। Apu Trilogy র চিত্রায়নে এই লং টেক, ডিপ ফোকাসের বহুল ব্যবহার, চিত্রভাষায় বিভিন্ন ডিটেলের মাধ্যমে আর্থসামাজিক প্রেক্ষাপটকে প্রকাশ করা, মেকআপ ছাড়া অভিনয় করানো, অপেশাদার অভিনেতা অভিনেত্রীদের দিয়ে অভিনয় করানো, স্বাভাবিক সূর্যের আলোয় ছবি তোলা, এবং প্রায় পুরো shooting টাই outdoor এ করা (বোড়ালগ্রাম এ), এ সমস্তই Neorealist ছবির বৈশিষ্ট্য বহন করে। সকালে যে আলো কাজের উপযোগী, সেটা পাওয়া মাত্র শুটিং শুরু হত, দুপুর একটা নাগাদ গরমের জন্য ঘণ্টা-খানেক কাজ থামিয়ে দুপুরের খাওয়া খেয়ে নেওয়া হত, তারপর যতক্ষণ আলো পাওয়া যায় ততক্ষণ অবধি শুটিং চলত। অধিকাংশ অভিনয়শিল্পী ছিলেন নবাগত। বৃদ্ধা ইন্দির ঠাকুরনের চরিত্রে অভিনয় করেছিলেন অতীত রঙ্গমঞ্চের অভিনেত্রী চুনিবালা দেবী। গ্রামের বৃদ্ধদের ভূমিকায় অভিনয় করেন বোড়াল গ্রামের গ্রামবাসীরা, যাদের প্রায় কারুরই কোনোরকম অভিনয়ের কোনও অভিজ্ঞতা ছিল না। চিত্রনাট্যের সংলাপ হিসাবে অধিকাংশ ক্ষেত্রে ব্যবহার করা হয়েছিল বিভূতিভূষণের  লেখা উপন্যাসের চরিত্রের সংলাপ। কোনও চরিত্রের জন্যই কোনোরকম মেকআপ ব্যবহার করা হয়নি। অভিনেতাদের মধ্যে কানু বন্দ্যোপাধ্যায় ছিলেন পেশাদার। শুটিঙের সময় বিনা মেকআপে অভিনয় করা নিয়ে তার খুঁতখুঁতেমির অন্ত ছিল না, তার মতে ওটা ছিল ঘোর উদ্ভট একটা কাণ্ড। বিভূতিভূষণের লেখা সংলাপ বলতে যে বড্ড সময় লাগে, এটা নিয়েও তার আপত্তি ছিল।
        
এই সমস্ত বৈশিষ্ট গুলোকে বিচার করে বলা যেতে পারে, Apu Trilogy হল ভারতবর্ষের তথা এশিয়ার প্রথম মুক্তিপ্রাপ্ত সার্থক প্রপঞ্চবাদী বাস্তবমূলক (Phenomenological Realism) চলচ্চিত্র, যেখানে একটি কাল্পনিক ঘটনাকে (বিভূতিভূষণের উপন্যাস) বাস্তবানুগ করে দেখানোর জন্য চলচ্চিত্রশিল্পের সমস্ত কলাকৌশল ও মালমসলাকে প্রয়োগ করা হয়েছে। Neorealist ছবির আর একটি অন্যতম উল্লেখযোগ্য বৈশিষ্ট শহরকেন্দ্রিকতা এই Trilogy-র প্রথম ছবিটিতে অনুপস্থিত হলেও এটাই এই Trilogy-র প্রধান গন্তব্য তথা উদ্দেশ্য, যা আধুনিকতার প্রধান সূচক।

কোন মন্তব্য নেই:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন