পৃষ্ঠাসমূহ

এই ব্লগটি সন্ধান করুন

সোমবার, ১৩ আগস্ট, ২০১২

পথের পাঁচালী - ১


নিশ্চিন্দিপুর নামে এক অখ্যাত অনামা এক দরিদ্র ব্রাহ্মন পরিবারের কাহিনিতে পথের পাঁচালীর সূচনা। পরিবারের কর্তা হরিহর যজমানি করে সংসার চালান। স্ত্রী সর্বজয়া, দূর সম্পর্কের দিদি ইন্দির ঠাকুরন এবং মেয়ে দুর্গাকে নিয়ে হরিহরের সংসার। সর্বজয়া গর্ভবতী, তার প্রতিবেশীরা কেউ তার প্রতি দুর্বিনীত, কেউ সংবেদনশীল। দরিদ্র জীবনের গ্রামীণ সঙ্কীর্ণতায় সর্বজয়া রূঢ়ভাষী, দূর সম্পর্কের ননদ ইন্দির ঠাকুরনকে সে তিরস্কার করে ঘর থেকে বের করে দেয়, অন্যের বাগানে ফল চুরি করার অপরাধে মেয়েকে মারধোর করে। ইন্দির, সর্বজয়া, দুর্গা, এরা সবাই আসলে প্রাক-বিশ্বযুদ্ধের আধা সামন্ততান্ত্রিক, আধা ঔপনিবেশিক গ্রামীণ সমাজব্যবস্থার প্রতিভূ, ফলে আধুনিকতা এদের আওতার বাইরে। এরপর অপুর জন্ম, ইন্দিরের আবার বাড়িতে ফিরে আসা। ইন্দিরের এই কয়েক মাস বাড়িতে অনুপস্থিতির সময়কালকে খুব সুন্দর ভাবে উপস্থাপন করেন পরিচালক, দেখা যায় দুর্গার প্রিয় বেড়াল বাচ্চাগুলো বড় হয়ে গেছে! অপুর বড় হয়ে ওঠার প্রথম দিন হিসেবে পরিচালক বেছে নেন অপুর পাঠশালা যাবার দিনটিকে। দুর্গা অপুকে ঘুম থেকে তুলে পাঠশালা পাঠানোর জন্য  ব্যাস্ত, ঘুমকাতুরে অপু দিদির তাড়নায় চাদরের ফুটো দিয়ে চোখ মেলে তাকায়, ভারতীয় সিনেমাও যেন এক নতুন দৃষ্টিতে নিজেকে খুজে পেল এই দৃশ্যের মধ্য দিয়ে! এই পাঠশালা যাবার দিনটিকে চিহ্নিত করার মাধ্যমে আধুনিকতার দিকে যাত্রাপথের প্রাথমিকতম বৈশিষ্টটিকে নির্দেশ করলেন পরিচালক। আধুনিক মানুষ হয়ে উঠতে অপুর সবচেয়ে বেশি প্রয়োজন অক্ষরজ্ঞান (Literacy)। শিক্ষার প্রতি এই দরিদ্র পরিবারটির আগ্রহ তাদেরকে গ্রামের অন্যান্য পরিবারের থেকে আলাদা করে তুলতে সাহায্য করে। এই ছবিতে প্রকাশ পায়, হরিহরের পূর্বপুরুষেরা বংশানুক্রমিক ভাবে শিক্ষিত ছিলেন। হরিহর নিজেও যাত্রাপালা লিখে রোজগার বাড়ানোর ইচ্ছা রাখে।

এইভাবে গ্রামের আর পাঁচটা সাধারণ ছেলের মত অপু বড় হয়ে উঠতে লাগল। দিদি দুর্গার সঙ্গে মিষ্টিওলার পিছু পিছু দিদির বন্ধুর বাড়িতে যাওয়া, লুকিয়ে আঁচার খাওয়া, চড়ুইভাতি, ইত্যাদি সমস্ত কিছুতে দিদির সঙ্গী হলেও আসলে কিন্তু তারা দুজন দুটো আলাদা সময়কে উপস্থাপন করে। দুর্গা গ্রামের মেয়ে, গ্রামের মেয়ের মতই সরল, তার গ্রামই তার পৃথিবী, তার জগত-সংসার। চড়ুইভাতি করতে করতে সে তার প্রিয় বান্ধবীর বিয়ের আর কতদিন বাকি, তার হিসেব করে, এটাই তার কাছে সবচেয়ে আনন্দের কাজ। অন্যদিকে, অপু কল্পনাপ্রবণ। ইন্দির ঠাকুরনের কাছে শোনা রূপকথা অথবা যাত্রায় দেখা পৌরাণিক কাহিনী সে নিজের মনের মত করে একা একা অভিনয় করে বেড়ায়। নতুনকে জানার এবং নিজের মত করে বোঝার এই আগ্রহটাই আধুনিকতার প্রতি অপুর সবথেকে বড় চালিকাশক্তি। এই আধুনিকতার অভিমুখে যাত্রাপথে তাকে প্রতক্ষ করতে হবে পাঁচজন প্রিয় মানুষের মৃত্যু, কারন তার পরিবারের অন্য পাঁচজনের এই আধুনিকতার পথে চলার ক্ষমতা ছিলনা। এই Trilogy তে প্রত্যেকটি মৃত্যু কোনও একটি বিশেষ সময়ের সমাপ্তি ঘোষণা করে, এবং কোনও একটি নতুন সময়ের জন্ম দেয়।

কোন মন্তব্য নেই:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন